২৮.১.১৮

সেবা সহজিকরণ বিষয়ক কর্মশালা (Service Process Simplification, SPS)

গ্রাহকের সন্তুষ্টি বিধান, প্রক্রিয়াগত খরচ কমানো এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার উদ্দেশ্যে ১৯৯০-এর দশকে পৃথিবীর বিখ্যাত বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ বিজনেস প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিং (Business Process Re-engineering, BPR) কার্যক্রম হাতে নেয়। পরবর্তীতে এই ধারণা সরকারী সেক্টরে অঙ্গীভূত হতে থাকে। পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধারণার চর্চা এবং বাস্তবায়ন হচ্ছে। বিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশে এর নামকরণ হয় 'সেবা সহজিকরণ বা 'Service Process Simplification, SPS'  নামে। জনগণের দোরগোড়ায় সেবাসমূহ পৌঁছে দিতে সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের নাগরিক সেবা প্রদানের বিদ্যমান ব্যবস্থা সহজ ও দ্রুততর করা অত্যাবশ্যক। সহজ ও জনবান্ধব সেবা চালু করতে হলে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিভিন্ন ধাপের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের বিকল্প নেই। সেবা প্রদান প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলে মিলে বিভিন্ন কাজের ধাপের সচিত্র বিবরণ নিয়ে খোলামেলা আলোচনার ফলে অপ্রয়োজনীয় কাজ, ধাপ ও নিয়ম/চর্চাসমূহ বেরিয়ে আসতে পারে। এর মাধ্যমে প্রতিটি সেবার বাস্তব ও সম্ভাব্য সমস্যা, প্রতিবন্ধকতা, প্রক্রিয়াগত শূন্যতা নির্ণয় করা যায়, যা সেবার বিদ্যমান ব্যবস্থা ও মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে, যাকে আমরা সেবা সহজিকরণ বা 'Service Process Simplification, SPS' বলতে পারি।
এই ধারাবাহিকতায়,
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ)’ শর্ত বাস্তবায়ন/লক্ষ্য অর্জন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রোগ্রাম মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন ( বিএইচবিএফসি) ৪টি সেবা প্রক্রিয়া সহজ, জনবান্ধব অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে ৩দিনের এসপিএস কর্মশালা ২৯-৩১ জানুয়ারি ২০১৮ অনুষ্ঠিত হয়।

কর্পোরেশনের ঋণ গ্রহীতাদের হিসাব প্রাপ্তি সহজিকরণ,  কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন সেবা সহজিকরণ, ঋণ গ্রহীতাগণকে আইনী সেবা প্রদান সহজিকরণ এবং ঋণ আদায় কার্যক্রম সহজিকরণ-এই চারটি সেবা প্রক্রিয়ার উপর বিশদালোচনার প্রেক্ষাপট তৈরি এবং তা বাস্তবায়নের দিক-নির্দেশনা হিসেবে কাজ করে  কর্মশালাটি।
৩১ জানুয়ারি ২০১৮ কর্মশালাটির সমাপণী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তাবৃন্দ গ্রুপভিত্তিক তাদের অভিনব সহজিকরণ প্রস্তাবনা স্লাইড-শো আকারে উপস্থাপন করেন। সমাপনী অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব মোঃ নাসির উদ্দিন আহমেদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন কর্মকর্তা রিসোর্স পারসন হিসেবে কর্মশালা পরিচালনা করেন। কর্পোরেশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দও এতে অংশগ্রহণ করেন। 
কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী সমাপনী বক্তব্যে সহজ ও জনবান্ধব সেবা চালু করতে বিদ্যমান সেবার অপ্রয়োজনীয় ধাপ ও নিয়মনীতি এবং প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যা হতে বেরিয়ে আসতে দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। 


ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বক্তব্যের কিছু চুম্বক অংশ-

৯.১.১৮

Probash Jibon Episode এবং জনাব দেবাশীষ চক্রবর্তী (ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিএইচবিএফসি)

আর্থিক খাতের বর্তমান অবস্থাঃ সমস্যা ও তা সমাধানের উপায়- ড. দৌলতুন্নাহার খানম (উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিএইচবিএফসি)

ড. দৌলতুন্নাহার খানম (উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিএইচবিএফসি)

ভূমিকাঃ
বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রাচ্যের অনুন্নত অর্থনৈতিক বলয়ের অন্তর্ভূক্ত। এ দেশের আর্থিক খাত খুব বেশি বড় এবং সমৃদ্ধ নয়। উন্নয়নশীল দেশসমূহের আদলে বাংলাদেশের আর্থিক খাতও প্রতিনিয়ত উন্নয়ন অর্জনের সংগ্রামে ক্রিয়াশীল। সহজ কথায়, আমাদের আর্থিক খাত এখনো অনুন্নত ও নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। খাতটির উন্নয়ন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রয়াশ এবং প্রচেষ্টা  অব্যাহত রয়েছে। তবে, এখনও কাংখিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারছে না। বাংলাদেশের আর্থিক খাত এখনও অনেক অনুন্নত ও দুর্বল। আর্থিক খাতকে আরো অনেক শক্তিশালী করতে হবে। দেশের কাংখিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং তা টেকসই  করার  জন্য ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।


দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তপসিলী সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকসমূহ, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, লিজিং কোম্পানী, বীমা প্রতিষ্ঠান এবং দুটি পুঁজি বাজার নিয়ে আমাদের আর্থিক খাত গঠিত। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনাসহ দেশের ব্যাংকিং খাত তথা আর্থিক খাতের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নয়ন, নোট ইস্যুকরণ, বৈদিশিক মুদ্রার রির্জাভ সংরক্ষণ, দেশের মুদ্রা ও ঋণ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নসহ সরকারের যাবতীয় লেনদেন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে আসছে। অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ব্যাংক, বীমা ও পুঁজি-বাজারের নানাবিধ আর্থিক আইন, বিধি, প্রবিধান ও নীতিমালা প্রণয়ন করে দেশের আর্থিক খাতের উন্নয়ন ও শৃংখলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কাজেই আর্থিক খাতের মূল নিয়ন্ত্রণ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের  হাতেই রয়েছে।


আর্থিক খাতের বর্তমান অবস্থাঃ
বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং অতঃপর তপসিলী ব্যাংকসমূহ বিধিবদ্ধ নিয়মাচারের মধ্যে থেকে আর্থিক খাতে জনসেবা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে। সে তুলনায় এ খাতের পুঁজিবাজার অংশটির অবদান হতাশাব্যাঞ্জক। সাম্প্রতিক সময় ও বছরগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ হানি, কয়েকটি রাষ্ট্র-মালিকানাধীন তপসিলী ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতি এবং শেয়ার বাজারে দুর্বৃত্তায়ন প্রতিহত করা যায়নি। বিপুল অংকের খেলাপী ঋণ, ঋণ অবলোপন, ঋণ পুনর্গঠন/পুন.তফসিলিকরণ, মানি লন্ডারিং এবং ক্ষেত্রবিশেষে সন্ত্রাসমূলক কর্মকান্ডে  অর্থায়নের মতো বাস্তবতা ও অভিযোগ রয়েছে। আর্থিক খাতের ব্যাংক-সেক্টরকে এসব সমস্যা ও দুর্নাম কাটিয়ে উঠতে হবে।

সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং বিহিত মুদ্রা (একই অর্থের পুনঃপুন পারফর্মেন্স) সৃষ্টি করা আর্থিক খাতভূক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের   মূল কাজ। এসব উদ্দেশ্য সামনে রেখে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে তপসিলী ব্যাংক সমূহকে রাষ্ট্রায়ত্বকরণ করা হয়েছিল। তখন ব্যাংকিং সেবা প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত করার তাগিদ ছিল। এর মধ্যে দিয়ে অর্থনীতির বুনিয়াদ তৈরীর প্রাথমিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়িতও হয়েছিল। পরবর্তীতে Financial Sector Reformation Program এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে অদ্যাবধি প্রায় অর্ধশত বেসরকারী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতকিছুর পরও এক্ষেত্রে প্রকৃত প্রতিযোগিতামূলক মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আর্থিক খাতে ক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠান ও সেবা সাধারণ মানুষ থেকে এখনো যথেষ্ট দূরে। এটিকে সর্বস্তরের মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এখনো অনেক পথ হাঁটতে বাকি।

দেশ স্বাধীন হয়েছে সাড়ে চার দশক হলো। এ লম্বা সময় ধরে আমরা যে স্থবির হয়ে আছি, তা-ও নয়। সহজ ভাষায় আমাদের আর্থিক খাতে একেবারে কাজ হয়নি বা হচ্ছে না, তা নয়। এ খাতে লাগাতার সংস্কার ও অন্তর্ভূক্তিমূলক নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। GDP-তে বছরে গড়ে ৬ শতাংশেরও অধিক হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। এ প্রবৃদ্ধি অর্জনে আর্থিক খাতভূক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই।

বর্তমানে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিভিন্ন ধরন ও প্রকৃতির অন্ততঃ ৬১টি ব্যাংক, ৩৩টি অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ৭৭টি বীমা কোম্পানী, ৫টি পুঁজিবাজার বিষয়ক প্রতিষ্ঠান, ১টি ক্ষুদ্র ঋণ বিষয়ক অথরিটি এবং অন্যবিধ ৪টি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বর্তমানে তফসিলী ব্যাংকগুলোর অন্ততঃ হাজারখানেক শাখা ব্যাংকিং সেবা এবং সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও বিহিতমুদ্রা সৃষ্টির কাজ করে চলেছে। ফলশ্রুতিতে, দেশে যথাযথ বিনিয়োগ পরিবেশ এবং উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। দেশে একটি আধুনিক অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলা সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য। আর্থিক বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরী। জরুরী বিবেচনায় এ খাতে সুষম উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে ইতোমধ্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

সাম্প্রতিক কালে দেশের "ব্যাংক কোম্পানী আইনে" প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, এটি অনেকটা যুযোপযোগী হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্থিক খাতের আধুনিকীকরণ ও আর্থিক কার্যক্রম জোরদারকরণে এ ব্যবস্থাটি ইতোমধ্যে সুফল দিতে শুরু করেছে। ব্যাংক ব্যবস্থাসহ আর্থিক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে এ আইন কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। 

বাংলাদেশের আর্থিক খাত ঋণ খেলাপী সংস্কৃতি দ্বারা পর্যুদস্ত । সাম্প্রতিককালে ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাবে কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারী সংগঠিত হয়েছে। মূলতঃ রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেয়ায় খেলাপী ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। খেলাপী ঋণের মধ্যে শ্রেণীকৃত ঋণসমূহ ক্রমশ মন্দ ঋণে রূপ নিচ্ছে। এসব মন্দ ঋণের বিপরীতে বর্ধিত হারে প্রভিশন (কু-ঋণ সঞ্চিতি) রাখতে গিয়ে প্রতিবছরই মূলধন ঘাটতিতে পড়ছে ব্যাংকগুলো।  সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশের ৫৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপী ঋণের পরিমান প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে স্বল্পসংখ্যক সরকারী ব্যাংকের অংশটাই বড়। এ খেলাপী ঋণের অধিকাংশই আবার গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে।  স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং প্রণোদনায়  উন্নতি হয়েছে। তথাপি, ঋণ খেলাপীদের হাত থেকে মুক্ত হতে পারছে না ব্যাংকগুলো। গত কয়েক বছরে বৃহদাকারের বেশ কয়েকটি ঋণ কেলেঙ্কারীর তথ্য উদঘাটন  এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু ঋণ জালিয়াতির ধকল কাটিয়ে ওঠার আগে আরও বড় একটি দুর্ঘটনা। এবারে  বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ  লোপাট। এ ঘটনা বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে দেশি-বিদেশী জালিয়াত চক্রের হীন তৎপরতার একটি সুস্পষ্ট প্রমান। ফলে, এ খাতে এখনো বিদ্যমান বা অনুদ্ঘাটিত দুর্বলতাসমূহ কাটিয়ে উঠা  বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

আর্থিক খাতে ক্রিয়াশীল বীমা কোম্পানীর বর্তমান সংখ্যা ৭৭টি। মানুষের জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি হ্রাস এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বর্তমানে অধিকতর প্রতিযোগিতা, প্রযুক্তি ও স্বচ্ছতা নিয়ে এ খাতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এ খাতের উন্নয়নে জাতীয় বীমা নীতি-২০১৪ প্রণয়ন করা  হয়েছে। জনগণের কাছে বীমার সুফল বিতরণের লক্ষ্যে এ নীতিমালায় ৫০টি সময়াবদ্ধ কর্ম-কৌশল রয়েছে। এছাড়া, সরকারী বীমা প্রতিষ্ঠানে সম্প্রতি চালু করা হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা বীমা বিষয়ক নতুন বীমা স্কীম।  এ স্কীম আর্থিক খাতে কমবেশি উন্নতি যোগ করতে সক্ষম হবে।

গত শতাব্দীর শেষ দশক এবং চলতি শতকের দ্বিতীয় দশককের শুরুতে দেশের পুঁজিবাজারে দুটি ভয়াবহ বিপর্যয় সংগঠিত হয়। এ তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের পুঁজিবাজার সংস্কারের তাগিদ প্রকট হয়ে ওঠে। বাজার সংস্কারের অংশ হিসেবে দুটি স্টক এক্সেঞ্জের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা পৃথক করা হয়েছে। এছাড়া, এ খাতে সংগঠিত অপরাধের শাস্তি এবং ভবিষ্যতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে Special Tribunal গঠন করা হয়। এ কোর্টের মাধ্যমে অপরাধীদের কৃতকর্মের বিচার ত্বরান্বিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ঋণ ও এর মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচী পৃথিবীতে একটি রোল মডেল। এ ঋণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী ৭৫৩টি প্রতিষ্ঠানকে আনুষ্ঠানিক ব্যবসায়ের সনদ প্রদান এবং অস্বচ্ছতা ও অনিয়মের কারণে ৫৬টি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায় থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। এর ফলে এক্ষেত্রে শৃংখলা তৈরী হয়েছে। বর্তমানে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (MRA)-এর তত্ত্বাবধানে এ খাতে সুব্যবস্থিত অর্থনৈতিক তৎপরতার মধ্যদিয়ে দেশের আর্থিক খাতে সুস্থতার মাত্রা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে অর্জনের টার্গেট নির্ধারণ করে দিয়ে প্রতি ছয় মাস অন্তর বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। পূর্বে এ মুদ্রা নীতিতে ছিল অপ্রকাশ্য এবং গোপন একটি বিষয়। এতে জনসম্পৃক্ততা ছিল না। বর্তমানে পেশাজীবীদের মতামত নিয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়। দেশে রিজার্ভের পরিমান ৩০০০ কোটি মার্কিন ডলার। ঋণের সুদ-হার হ্রাস পেয়েছে। টাকার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা রয়েছে। ব্যাংকে রয়েছে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগযোগ্য তহবিল। মুদ্রাস্ফীতির হারও সহনীয়। এসব বিবেচনায় উপযুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য হালনাগাদ মুদ্রানীতি ঘোষণার রেওয়াজ তৈরি করা হয়েছে। আর্থিক খাতের এ অবস্থা অদূর ভবিষ্যতে অবশ্যই সুফল বয়ে আনবে।

দেশের আর্থিক খাতের ব্যবসা ও সেবা কার্যক্রমে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। বিশেষত ই-কমার্স, Core-Banking Solution System, মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং-এ এর মতো আধুনিকতা প্রবর্তিত হয়েছে। ফলে, ব্যাংকসমূহে আমানত ও লেনদেনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফেব্রুয়ারি-২০১৫ এর হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকসমূহে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ১ শত ১০ বিলিয়ন টাকা। পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ২ শত ১৩ বিলিয়ন টাকা। ঐ একই সময়ে মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং-এ গ্রাহক সংখ্যা ছিল ২৫.৮ মিলিয়ন এবং তাদের লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১০ বিলিয়ন টাকা। সর্ব-সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে বর্তমানে শুধুমাত্র মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ গড়ে ৬ শত ১৬ কোটি টাকা (দৈনিক জনকন্ঠ ; তাং ২৯.০৬.২০১৬)। দেশে আর্থিক খাত এগিয়ে যাওয়ার প্রমান হিসেবে বর্তমানে এ ধরনের অনেক পরিসংখ্যান তুলে ধরা সম্ভব।

দেশের আর্থিক খাত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় গুরুত্বপ–র্ণ উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করে চলেছে। এক পরিসংখ্যান মতে গত ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (PKSF) মোট ৮১ লক্ষ উপকারভোগীর মাঝে ১৮৪.৬০ বিলিয়ন টাকার ঋণ বিতরণ করে। এ সময় ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রায় ৩ লক্ষ ৬২ হাজার উপকারভোগীর মাঝে ৬৬৫.৭৮ বিলিয়ন টাকার ঋণ বিতরণ করে। একই সময়ে সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের  নতুন জীবন  কর্মসূচীর আওতায় ১ লক্ষ ২৮ হাজার উপকারভোগীর মধ্যে ২.৫৫ বিলিয়ন টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এসব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) -এ  উচ্চতর প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হচ্ছে।



আর্থিক খাতে বিরাজমান সমস্যা:

বাজার ব্যবস্থায় বিশৃংখলা ও প্রতিযোগিতার অভাবঃ

 বাংলাদেশের আর্থিক খাতে বিভিন্ন প্রকার ও প্রকৃতির ব্যাংক ব্যবস্থা ক্রিয়াশীল। রাষ্ট্র-মালিকানাধীন ব্যাংকসমূহ সরকার আরোপিত নানাবিধ সেবামূলক দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লাভ-লোকসানের হিসাব এসব ব্যাংকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। নামমাত্র মূল্য বা ফি/কমিশন-এর বিনিময়ে সরকারী দায়িত্ব পালনই মুখ্য বিষয় হয়ে থাকে। কোনও পরিস্থিতিতে অস্বিত্বের সংকটজনিত আশংকায় ভোগে না এসব  প্রতিষ্ঠান। এমতাবস্থায়, এসব ব্যাংক বা এ ধরনের অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহ বাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে চলে। তারা সরকারী দায়িত্ব পালন ও রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্রতি মনোযোগী হয়ে থাকে। অপরপক্ষে, এ সুযোগে বেসরকারী ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা কোম্পানীসমূহ নানাবিধ সিন্ডিকেট গঠন ও অনৈতিক পন্থা অবলম্বনের সুযোগ কাজে লাগায়। তারা গোষ্ঠীগত বা যৌথ স্বার্থ কায়েম করে চলে। ফলে, চরম বিশৃংখলার পাশাপাশি অসুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়।

মাত্রারিক্ত সরকারী হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক সংসর্গঃ
রাষ্ট্র-মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবসায়িক অর্জন নিতান্ত অপ্রতুল। এর বিপরীতে তাদের পৃষ্ঠপোষকতাজনিত বিধিব্যবস্থার কারণে সাধারণভাবে সর্বক্ষেত্রে মাত্রারিক্ত সরকারী হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে পড়ে। অন্যদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যবসায় অনুমোদন, পর্ষদ গঠন, ঋণ মঞ্জুরীর ক্ষেত্রে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গী ইত্যাদি কারণে আর্থিক খাতে সমতাপূর্ণ সমতল ব্যবসা ক্ষেত্র তৈরী হয় না। অনেক ক্ষেত্রে প্রভাব, পক্ষপাতিত্ব ও প্রতিহিংসার কারণে এক্ষেত্রে সুস্থতা বিরাজ করে না।

পরিচালন ও ব্যবস্থাপনাগত অদক্ষতাঃ
যোগ্য, দক্ষ ও উপযুক্ত লোকেদের পরিবর্তে অনেকক্ষেত্রে অযোগ্য, অদক্ষ ও ধামাধরা ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। এ অদক্ষতার সুযোগে ব্যবসায় পরিকল্পনায় বন্ধাত্ব সৃষ্টি হয়। তাদের দুর্বল পারফর্মেন্স এবং উপযুক্ত সুরক্ষার সুযোগে জাল-জালিয়াতি, দুর্নীতি সংঘটিত হয়। ফলে, সমগ্র খাত-এর উপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতার অভাবঃ
এখনো এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ অবস্থা সেক্টরটির অধিকতর উন্নয়নের পথে অন্যতম বাধা। দুর্বল ও দ্ব্যার্থবেধক নীতিমালা ও বিধিব্যবস্থা, যথাযথ অডিট ও মনিটরিং ব্যবস্থার অভাব, শাস্তি ও বিচারাহীনতার কারণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতার ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে যায়।

সরকারী ঋণঃ
বিভিন্ন প্রয়োজনে অর্থের বাজার থেকে প্রায়শঃ সরকারসমূহ অঢেল অর্থের ঋণ গ্রহণ করে থাকে। এর ফলে, অনেক ক্ষেত্রে বিনিযোগ পরিস্থিতি ক্ষুন্ন হয়। তারল্য সংকটে কলমানি মার্কেটে অস্থিরতা তৈরী হয়। এ সংস্কৃতি বাংলাদেশের আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রায়শঃ সাবলীল ব্যবসায় থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।

অদক্ষতা ও পেশাদারিত্বের অভাবঃ
 অদক্ষতা ও পেশাদারিত্বের অভাব সেক্টরটির যথোপযুক্ত বিকাশের পথে অন্যতম অন্তরায়। অর্থের ব্যবসায় এবং এ সংক্রান্ত সেবা-কাজে দক্ষ ও পেশাদার কর্মীবাহিনী নিয়োগ যেমন হয় না, তেমনিভাবে নিয়োগ-পরবর্তী সময়ে দক্ষতা ও পেশাদায়িত্ব অর্জনের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণাদির ব্যবস্থা নেই।

সমস্যার সমাধান (সুপারিশ):
একটি দক্ষ, অন্তর্ভূক্তিমূলক ও শক্তিশালী আর্থিক বাজার এবং সেবা-ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে নানাবিধ ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। এসব ব্যবস্থা একটি উন্নত আর্থিক খাত গঠনে কমবেশি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে-সন্দেহ নেই। এ পর্যায়ে উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে-এ খাতের সমস্যা থেকে উত্তোরনের উপায় হিসেবে নিম্নোক্ত কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারেঃ
১. বিধি ও নীতি মালা শক্তিশালীকরণঃ দেশের আর্থিক খাতের বাস্থিত ও সুষম উন্নয়নে এতদসংক্রান্ত যাবতীয় বিধিবিধান, নীতিমালা ও নজরদারী শক্তিশালী করা যেতে পারে;
২. প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণঃ অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধিবিধান, নীতিমালা, আইন-কানুনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন হয় না। এসবের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা গেলে শৃংখলা ও উন্নয়ন বিধানে অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ;
৩. সংস্কার ও পুনর্গঠনঃ বর্তমান বিশ্বের উন্নত আর্থিক খাতের অনুরূপ একটি ব্যবস্থাকে মডেল হিসেবে সামনে রাখতে হবে। স্থানীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিজস্ব মিশন ও ভিশনের জন্য সহায়ক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটি পুনঃসংস্কার ও পূনর্গঠনের চিন্তা করা যেতে পারে। বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের পর দীর্ঘ ২৫ বছরেরও অধিক সময় চলে গেছে। এ সময়ের সৃষ্ট পশ্চাদপদতার জায়গাগুলি চিহ্নিত করে এ উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে;
৪. ন্যায়পাল নিয়োগঃ দেশের আর্থিক খাতের উন্নয়নে ন্যায়পাল নিয়োগ দীর্ঘদিনের পুরনো একটি দাবি। এখাতে উত্থাপিত যেকোন অভিযোগের বিষয়ে নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত-তদন্তক্ষম একজন ন্যায়পালের নিয়োগ সুফল বয়ে আনতে পারে;
৫. নিরীক্ষা ও নজরদারী বৃদ্ধিঃ খাতটির উন্নতিকল্পে অভ্যন্তরীণ ও বহি. অডিট ব্যবস্থা এবং শুদ্ধতা নিশ্চয়নের লক্ষ্যে উপযুক্ত নজরদারী ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হলে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
৬. মেধার মূল্যায়ন ও শিষ্টের লালনঃ মেধা, মনন ও সৃজনশীল ক্ষমতা দিনবদলের মূল নিয়ামক। এখাতের উন্নতির লক্ষ্যে মেধা, মনন ও সৃজনশীলতাকে মূল্যায়ন করতে হবে। মেধাবী ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্নদের আকৃষ্টকরণ, তাদের যোগ্যতার স্বীকৃতি, উপযুক্ত কর্মপরিবেশ ও লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদান এবং প্রণোদনা জোরদার করতে হবে। সাথে সাথে অপতৎপরতা এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থকারীদের চিহ্নিত করে তাদের প্রতিহত করতে হবে।

উপসংহারঃ
প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য, কর্মক্ষম ও সহজলভ্য বিশাল জনশক্তি, সম্ভাবনাময় ভৌগলিক অবস্থান, ব্যবসায় ও বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের কারণে বিকাশমান অর্থনীতির আদর্শ পটভূমি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এদেশের আর্থিক খাতের উন্নয়নের জন্য এখন স্রেফ সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও বিচক্ষণতা প্রয়োজন। দেশপ্রেম ও নিষ্ঠা নিয়ে স্বপ্নের পথে হাঁটলে লক্ষ্যে পৌছানোটা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।