২৭.১২.১৭

ভালো ছাত্র, ভালো কর্মী হওয়া সহজ কিন্তু ভালো মানুষ হওয়া সহজ নয়

শেখ আমিনউদ্দিন আহমেদ
চেয়ারম্যন (সাবেক)
(১১-১১-২০১৪ হতে ২৭-০২-২০১৮)
বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী, যারা দেশ ও এদেশের জাতির জনককে ভালবাসেন, তারা সবাই স্বপ্নের সোনার বাংলার সফল বাস্তবায়ন চান। এ দেশ আমাদের মা। এ দেশের প্রতিটি মানুষই সে মায়ের সন্তান। নিশ্চয়ই আমরা সবাই এ দেশ-এর জনগণকে ভালবাসি। এর অর্থ সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা আমাদের সকলেরই স্বপ্ন।

বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে কিছু মানুষের অতি লোভ, নীতিহীনতা ও দুর্নীতি তাঁর মানসপটে দাগ কেটেছিল। আজও বাংলাদেশের সমাজ জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতির আভাস পাওয়া যায়। এসব দুর্নীতি নিরসন করার জন্য আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

সরকারের ‘জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ শব্দগুচ্ছের আগে আরো কয়েকটি শব্দ আছে। তা হলোঃ সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়। জাতীয় জীবনে এ প্রত্যয় বাস্তবায়নের জন্য সবার আগে আমাদের প্রত্যেককে সোনার মানুষ হতে হবে।

সোনর মানুষ হয়ে ওঠার উপায় নিয়ে মনিষীরা অনেক ভেবেছেন। যাঁর যাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী অনেক অনেক কথাই বলেছেন। মরমী সাধক ফকির লালন শাহ্ এর একটি অতি জনপ্রিয় গানের মধ্যে সোনার মানুষ হওয়ার উপায় সন্ধান হয়েছে এভাবে ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি ... ’।

লালনের একথার মর্মার্থ তো এমনই যে, সমাজ-সংসার, দেশ এবং বিশ্ব-রাষ্ট্রের মানুষের প্রতি আমাদের প্রেম থাকতে হবে। মানুষের মতামত ও অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে। মানবতার প্রতি ভালোবাসাই আমাদের সোনার মানুষ করে তুলবে। কিন্তু মানুষের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা উদ্রেক করার উপায় কি?

সোনা মূল্যবান ধাতু। মিস ইউনিভার্স-এর অঙ্গে ব্যবহৃত সোনা আর একজন সাধারণ মানুষের অঙ্গুরীয়’র সোনা একই ধাতু। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো যে, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে মূল্যবান ধাতু সোনার মতো হতে অবিরাম তাগিদ প্রদান অব্যাহত আছে। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে এতো তাগিদ, এতো বিধি-ব্যবস্থা,  এতো শাস্তির ভয় আর ইহকাল-পরকালে অশেষ পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি-কোন কিছুর বিনিময়েই মানুষকে সোনার মতো মূল্যবান ধাতুতে পরিণত করা যাচ্ছে না। 

বর্তমান জামানার শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি কম্পিউটার। এর দুটি পার্টঃ হার্ডওয়্যার ও সফট্ওয়্যার। এ যন্ত্রটিতে যেমন সফট্ওয়্যার ইন্সটল দেয়া হবে, পারফর্মেন্স হবে সে অনুযায়ী। এবার মানুষকে কম্পিউটার গোছের কোন এক যন্ত্র ঠাওরে নেয়া যাক! এর অধিকাংশই হার্ডওয়্যার। মগজটা হার্ডডিস্ক। এখানে নীতি-নৈতিকতা, সততা ও নিষ্ঠাচার নামের কিছু বিশেষ অনুভূতিপ্রবণ সফট্ওয়্যার ইন্সটল করতে পারলেই হলো! ফলাফল সুনিশ্চিত- পরিশুদ্ধ ভালো মানুষ!

মানুসের মস্তিষ্কে নীতি-নৈতিকতা, সততা ও নিষ্ঠাচার-এর মন্ত্র ইন্সটল করতে হবে! ধারণা করা হলোঃ এতো সহজ কাজ; কোনও ব্যাপারই না। কিন্তু এটাই মস্ত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। ইনস্টল করতে চাইলেই ইনস্টল হচ্ছেনা। লোভ-লালসা আর পাপাচার ভাইরাসের পেটে চলে যাচ্ছে, নয়তো হ্যাকিং হয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্ক।

প্রকৃতপক্ষে, মানুষ যখন যড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তখন তার মনের মধ্যে একটি সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। তাকে বলা হয় অন্তরের সৌন্দর্যের ফসল। এই সৌন্দর্যের যখন স্ফূরণ ঘটে, তার প্রতিচ্ছবি বাহ্যিকভাবে তার কাজকর্ম-মননে প্রতিফলিত হয়। তখন তারা নিজের স্বল্প প্রয়োজন ছাড়া তাদের যত সম্পদ এবং মন-মানসিকতা নিয়ে দেশ এবং জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করে, তখন তাদের সোনার মানুষ বলে।

ধরে নিই, আমাদের সকলের মস্তিষ্কে সুনীতির সফট্ওয়্যার ইন্সটল নিয়েছে। মহান রাব্বুল আল-আমিনের অপার করুণায় আমরা সবাই শুদ্ধ মানুষ। কিন্তু আপনার আমার শুদ্ধতাই শেষ কথা নয়। আমাদের পরিবার, নিজ কর্মস্থল, স্বীয় প্রতিষ্ঠান, সমাজ এবং দেশের সবাই কি শুদ্ধ? তাহলে এ দেশ কেন সোনার বাংলায় পরিণত হচ্ছে না? আমাদের দেশ-মাতৃকার সন্তানদের ঘাটে ঘাটে নাকাল কেন হতে হয়? আমাদের সেবায় জনগণ কেন সন্তুষ্ট নয়?

সকল প্রশ্নের উত্তরই আমাদের জানা আছে। আমরা সকলকে সকলে সেভাবে না চিনলেও অন্তত: নিজেকে খুব ভালভাবে চিনি ও জানি। নিজেকে শুধরানোর অবকাশ যদি নাই থাকে, সমাজ-সংসার শুধরানোর দায় থেকে পালিয়ে বাঁচার অবকাশ নাই। নীতি-নৈতিকতা এবং সততা ও নিষ্ঠাচার প্রয়োগের স্থানগুলো কি আমাদের দৃষ্টির আড়ালে, নাকি নাগালের বাইরে? যদি তা না হয়, তাহলে প্রকৃত সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।

ব্যক্তি জীবনে আমরা হয়তো ভালো সন্তান, ভালো আত্মীয়, ভালো প্রতিবেশি, ভালো সঙ্গী, ভালো পিতা বা মাতা। ছাত্রজীবনে হয়তো ভালো ছাত্রও ছিলাম; চাকরী জীবনে ভালো কর্মীও হয়তো হতে পেরেছি। এগুলো অবশ্যই ভালো অর্জন। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে এরকম ভালো হওয়া যতটা সহজ, সার্বিক বিচারে ভালো একজন মানুষ হওয়া ততোটা সহজ নয়।

আমাদের প্রত্যেককে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভালো মানসিকতার গন্ডি ছাড়িয়ে একজন পরিপূর্ণ ভালো মানুষ হয়ে উঠতে হবে। নীতি-নৈতিকতা এবং সততা ও নিষ্ঠাচার পালন ও প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আমাদের বিজয়ী হতেই হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন